গেল বছরের বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি

‘তথ্য-প্রযুক্তি’ -আধুনিক বিশ্বে এই শব্দটির প্রয়োগ সর্বক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। ‘তথ্য-প্রযুক্তি’ পরিণত হয়েছে একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর মেরুদণ্ড হিসেবে। বাংলাদেশে এর ব্যবহারও ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রাকে আরো গতিশীল করার লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হচ্ছে। সরকার দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার ও বিকাশের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার এবং দেশের আপামর জনগণকে এই প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করার জন্যে বর্তমান সরকার বদ্ধ পরিকর। ‘রূপকল্প ২০২১: ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার কাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে বর্তমান সরকার কর্তৃক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ

ইউনিকোডভিত্তিক নতুন ফন্টঃ
একুশের (২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে) প্রথম প্রহরে শহীদ মিনার প্রান্তরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনিকোড ভিত্তিক প্রমিত বাংলা ফন্ট ‘আমার বর্ণমালা’ -এর প্রথম ফন্ট ‘শাপলা’ উদ্বোধন করেছেন। ফন্ট তৈরিতে কাজ করছে বাংলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিকস ডিজাইন বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম। কম্পিউটার টাইপিং –এ ব্যবহারের জন্য, বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে বানানো এটাই হচ্ছে প্রথম ফন্ট। এ ফন্টে ইউনিকোড সুবিধার সঙ্গে প্রমিত বাংলা, যুক্তবর্ণের সহজীকরণ ও এর রূপ নির্দিষ্ট করণে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই ফন্টটি সবার জন্য উন্মুক্ত (www.amarbornomala.gov.bd -এই ওয়েবসাইট থেকে ডউনলোড করে ব্যবহার করা যাবে)। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এর বিতরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

ইনোভেশন ফান্ডঃ
রাষ্ট্রীয় সেবার মান উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে সৃজনশীল প্রচেষ্টাকে সহায়তা দিতে যাত্রা শুরু করেছে ‘ইনোভেশন ফান্ড’। গত ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে এই ফান্ডের উদ্বোধন করেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ‘একসেস টু ইনফরমেশন (ওটুআই)’ প্রকল্পের আওতায় এতে সহায়তা দিচ্ছে সরকার, ইউএনডিপি এবং একশন এইড। সেবামূলক কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্যবান্ধব সেবা প্রদান ব্যবস্থা, সেবা বিকেন্দ্রীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, গ্রামীণ উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, স্বল্পমূল্যের প্রযুক্তি, তথ্যে প্রবেশাধিকার, বাংলা ভাষা সহায়ক সফটওয়্যার ইত্যাদি। এ অর্থায়ন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম হবে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলা প্রথম এবং পূর্ণাঙ্গ সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকাঃ
বাংলা নববর্ষের (১৪২০) ঠিক আগের রাত ১৩ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলো পৃথিবীর প্রথম এবং পূর্ণাঙ্গ বাংলা সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ এবং জিপি আইটি লিমিটেড যৌথভাবে তৈরি করেছে এই বাংলা সার্চ ইঞ্জিন। এটা প্রথমে শুরু হয়েছিলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের একটি প্রজেক্ট হিসাবে। প্রত্যেক বছরের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের একটা প্রজেক্ট করে জমা দিতে হয়। সেই রকম একটা প্রজেক্ট ছিলো পিপীলিকা। সেই প্রজেক্ট যখন শুরু হলো তখন তারাই প্রজেক্টটির নাম দিয়েছিলো পিপীলিকা। পিপীলিকা যেমন সব জায়গা থেকে ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করে রাখে, তেমনি সার্চ ইঞ্জিনের ভিতরে সব তথ্য খুঁজে খুঁজে রেখে দেওয়া হবে সেই ধারনা থেকে এর নাম। এটি পূর্ণাঙ্গ সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে ২০ কোটির বেশি মানুষকে বাংলা তথ্য খোঁজায় সহায়তা করবে। পিপীলিকায় বাংলায় তথ্য অনুসন্ধানের জন্য নিজস্ব বাংলা অভিধান ব্যবহার করা হয়েছে। যদি ব্যবহারকারী কোনো শব্দের ভুল বানানও দেন, পিপীলিকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঠিক বানান খুঁজে নিয়ে সেই নতুন শব্দ দিয়ে অনুসন্ধান চালাবে, ফলাফল দেবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারকারীকে জানিয়ে দেবে তাঁর কোন শব্দের বানান ভুল ছিল, সঠিক কোন শব্দ দিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। সংবাদ অনুসন্ধান, ব্লগ অনুসন্ধান, বাংলা উইকিপিডিয়া অনুসন্ধান ও জাতীয় ই-তথ্যকোষসহ আরও অনেক কিছু থাকছে পিপীলিকায়।

দেশে সফটওয়্যার খাতে ১০ কোটি ডলার আয়ঃ
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) উদ্যোগে একটি বিশেষ সাংবাদিক সম্মেলনে (৩১/০৮/২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত) জানানো হয়, এবারই প্রথম আইসিটি খাতে রপ্তানি আয় ১০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে সফটওয়্যার ও আইসিটি খাতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ৫০ ভাগ। এ প্রবৃদ্ধি রপ্তানিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০টি খাতের অন্যতম। দেশের সফটওয়্যার ও আইসিটি খাতে রপ্তানি আয় ১০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০১.৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। বিগত বছরের তুলনায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৪৩.৫৩ ভাগ। দেশের আইসিটি খাতে এটি যুগান্তকারী অর্জন। আইসিটিতে রপ্তানির এ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে এবং সম্মিলিত উদ্যোগ আর পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে আগামী ২০২১ সাল নাগাদ এ খাতে ১০০ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তৃতীয় প্রজন্মের নেটওয়ার্ক বা ৩জিঃ
৩জি (ইংরেজি: 3G) হল থার্ড জেনারেশন বা তৃতীয় প্রজন্ম-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি হল তৃতীয় প্রজন্মের তারবিহীন নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি। ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ -বহুল প্রত্যাশিত ৩জি সেবা চালু করার লক্ষ্যে অবশেষে দেশের বেসরকারী অপারেটরগুলো ৩জি’র লাইসেন্স পেয়েছে। ফলে চারটি মোবাইল ফোন অপারেটর থ্রিজি সেবা দিতে পারবে। তারা হল- গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল। সরকারি প্রতিষ্ঠান টেলিটক এই সেবা দিয়ে আসছে প্রায় এক বছর আগে থেকে। আর দেশের প্রথম মোবাইল অপারেটর সিটিসেল এই নিলামে অংশগ্রহণ করেনি। নিলামে অংশ নিয়ে অপারেটর চারটি থ্রিজির জন্য সরকারের কাছ থেকে তরঙ্গ বরাদ্দ নিয়েছে। থ্রিজি প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় সুবিধা হলো, এই প্রযুক্তি কার্যকর থাকলে মোবাইল হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে ভয়েস সুবিধার পাশাপাশি ব্যবহারকারী উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া টিভি দেখা, খেলা দেখা, ভিডিও ক্লিপস আদান-প্রদান, ভিডিও কনফারেন্স সবই সম্ভব। থ্রিজি বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের একমাত্র সমাধান। গণ ব্রডব্যান্ড ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন অবান্তর। কেননা ডিজিটাল বাংলাদেশে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের পরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট হবে জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার। মোবাইল নেটওয়ার্ক ছাড়া অন্য কোনো নেটওয়ার্কে যে কোনো লোকেশনে ব্রডব্যান্ড দেয়া প্রায় অসম্ভব। বর্তমান সময়ে ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কের জন্য পৃথিবীতে সাধারণত তিন ধরনের নেটওয়ার্ক অবকাঠামো ব্যবহার করা হচ্ছে—১. ফাইবার অপটিক ক্যাবল; ২. ওয়াইম্যাক্স ও ৩. থ্রিজি মোবাইল নেটওয়ার্ক।

Facebook
Twitter
WhatsApp