আমি নাকি এক্সপার্ট প্রেমিকার বিয়ে দিতে…!

রবিউল ইসলাম (রবি)- বাঙালি পুরুষের সবচেয়ে স্থায়ী সাফারিং বোধ হয় প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়া। আর তাই প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেলে অবসাদে ভুগেন প্রেমিকরা। সেই টেনশনে শরীরটা একেবারে ভেঙে পড়ে। অনেকে ঠিকমত খাওয়া-দাওয়াও করেন না। আজেবাজে কাজেও জড়িয়ে পড়ে অনেক প্রেমিক। দুশ্চিন্তায় দাড়ি-গোঁফে অনেকেই আবার পাগল-পাগল।

অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য যে আমি যখন ক্লাস ফাইভে, তখন প্রথম প্রেমে পড়ি পাশের বাড়ির নাফিজা আপার। তিনি আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে স্কুলে যেত আর আমি স্কুলে না গিয়ে তাকে এক নজর দেখার জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করতাম। স্কুলের যাওয়ার পথে আমাকে দেখে সে যে মিষ্টি একটা হাসি দিত, তাতে মনে হয় ওই হাসিতে লুকিয়ে থাকতো টাঙ্গাইলের মিষ্টির সব রস, আর আমি সেই মিষ্টির রসের গ্রানে হয়ে যেতাম বেহুশ।

আসলে তখনও জানতাম না যে তার সাথে চলছে আমার প্রেম। আর সেজন্যই আমার মনের ভিতর জ্বলছে আগুন। তবে সত্যিকারের প্রেম বুঝে বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ আম্মু একদিন বলল আজ নাফিজার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। শুনেই যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। পরে স্কুলে যাওয়া বাদ দিয়ে দুদিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম। বিয়ের দিন কলা গাছ কেটে এনে বিয়ের গেট সাজালাম আর বিয়েতে ধুমসে পোলাও খেলাম।

দ্বিতীয়বারের ঘটনা যখন আমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। নাম মুক্তা, মেয়েটিকে দেখেই আমার ভেতরে হঠাৎ কে যেন গেয়ে উঠল ‘বালিকা কোথা হতে আনলে গো তুমি এমন রূপের বন্যা! মেয়েটি আমার খালার বাড়ির কাছেই থাকতো, তাই প্রতি সপ্তাহে আমার স্কুল বন্ধের দিন খালার বাড়িতে হুড়হুড় করে চলে যেতাম তাকে একনজর দেখার জন্য। আমার ছোট একটি খালাত ভাই ছিলো যার ছিলো সিরিয়াল দেখার তীব্র নেশা। তবে বাড়িতে খালু টিভি কিনে নাই একমাত্র ওর কারণেই, যদি সপ্তাহে দুইটা রিমোট বদলাতে হয় এই ভয়ে।

তাই খালাত ভাইয়ের সাথে একদিন মুক্তাদের বাড়িতে গেলাম টিভি দেখতে, সেদিন কিভাবে যেন ওর হাত ছুঁয়ে ফেললাম। পরবর্তী তিন দিন সেই সুখে রাতে ঘুমাতে পারলাম না। দিনের বেশির ভাগ সময়ই নিজের হাত নিজেই ধরে বসে থাকতাম। আমার এই অবস্থা আব্বু-আম্মু লক্ষ করে শেষে জোর করে একদিন সেই হাত সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে দিলে আমি স্বাভাবিক হলাম।

কিছুদিন কেটে গেল সেই সুখেই, পরে বন্ধুদের পাল্লায় পরে একদিন মেয়েটা স্কুলে যাওয়ার সময় তার গতিরোধ করলাম। জানালাম তাকে আমার মনের সব কথা, শুনে মেয়েটা সেদিন বলেছিল তুমি যদি রাস্তার পাশের ওই পুকুর থেকে এক বোতল পানি আমার সামনে খেতে পারো আমি তাহলে তোমার সাথে প্রেম করতে পারি। তার কথা শুনে যেন আমি থমকে গেলাম, কারণ পুকুরটি ছিল ময়লা আবর্জনায় ভরপুর, যার দুর্গন্ধে রাস্তা দিয়ে মানুষ যেতেও পিছপা হতেন। সেদিন নিজেই কোনভাবে কাটিয়ে চলে এলাম। তার তিন মাসের মাথায় খালাত ভাই একদিন মোবাইল করে বলল ভাই তোমার সেই মুক্তার বিয়ে হয়ে গেছে গতকাল!

‘আমি বিয়ে করতে পারলাম না’ এই আফসোস নিয়েই বাঁচতে চাইলাম বাঁকিটা জীবন। তবে হলো না সেই আশা পূরণ। ক্লাস নাইনে উঠার পরে ঘটল আবার এক বিপত্তি। বিপত্তি মানে প্রেম, এবার পড়লাম একই ক্লাসের পাশের গ্রামের তাসলিমার সাথে। শুরু হলো আমার প্রেম জীবন, বাড়ি থেকে টিফিন খাওয়ার কথা বলে বেশী বেশী টাকা এনে তাসলিমা সহ ওর বান্দবীদের ঝালমুড়ি কিনে দিতাম আর টিফিন শেষে দোকান থেকে ছোলা ভাজা এনে ক্লাসে ঢিল ছুড়তাম ওর দিকে। আর লাগতো অন্য মেয়েদের গায়ে। স্কুল ছুটি শেষে শিক্ষক মিলনায়তনের আমাকে এনে উপযুক্ত বিচার করেই ছেড়ে দিত স্যারেরা।

হঠাৎ একদিন বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গেলাম আর এই পাশ থেকে মোবাইলে খবর আসলো আজ তাসলিমার বিয়ে। এই কথা শুনার পর তখন আর কিসের ট্যুর? তখনি রওয়া দিলাম, আর সন্ধার দিকে ওদের বাড়ির সামনে পৌচ্ছা মাত্রই দেখি তাসলিমাকে গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে ওর স্বামী।

এবার বেশ কষ্ট পেয়েছিলাম, সেই জন্যই বোধহয় বন্ধুরা মিলে সেদিন রাতে একটা পার্টির আয়োজন করেছিল, সেখানে আমার কাছে তাসলিমার যত ছবি ছিলো সব আগুনে পুড়ে সবাই এক লাইনে সারিবদ্ধ ভাবে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করে মেয়েটাকে ভুলে গেলাম। সেই কষ্টের মাত্রা এত বেশী ছিল যে, মনে হচ্ছিল এই কষ্টের বোঝা মাথায় নিয়েই বোধহয় সারাজীবন আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে।

সেই চিন্তা নিয়েই কলেজে উঠেছিলাম আর প্রেমে পড়েছিলাম রুহির। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই কেটে গিয়েছিল প্রায় ছয়টা মাস। এই ছয়টা মাসে কত টাকাই না গেয়েছে ফাস্ট ফুডের বিল আর ওর বাড়িতে যাওয়ার গাড়ি বাড়া দিয়ে। প্রেম নিবেদনের যখন উপযুক্ত সময় এল, তখন সাতদিন ভেবে একটা চিঠি লিখে নিয়ে সেদিন কলেজে গেলাম। কলেজ সরগরম। চারদিকে উত্তেজনা! আমার এক বন্ধুর হাত ধরে নাকি পালিয়ে গেছে রুহি! বন্ধু হয়ে আমার সাথে আরিফ এমন বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারলো আর মেয়েটাই বা ওই মুটুর ভিতর কী পেল, ভাবতে ভাবতেই কাটল কলেজের প্রথম বর্ষ।

মাথায় আর আজেবাজে চিন্তে ভাবনা নেই, এইচএসসি তে ভালো রেজাল্ট করতে হবে আগেই বলে দিয়েছিল আব্বু, না হলে রিকশা কিনে দিবে। কারণ এসএসসি তে আমার রেজাল্ট ছিলো হতাশাজনক। যা শুনে পাশের বাড়ির ছোট মেয়েটাও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ছিল, মিষ্টি খেতে পারলো না বলে। যাহোক ভালো রেজাল্টের বুক ভরা আশা নিয়ে শেষ বছরটাতে প্রাইভেট পড়া শুরু করলাম স্থানীয় একটি মহিলা কলেজের মেয়েদের সাথে। শুনেছি মেয়েরা নাকি ছেলেদের থেকে লেখাপড়ায় এগিয়ে তাই তাদের সাথে পড়াটা ছিল পরীক্ষায় যেন ওদের মতো রেজাল্ট ভালো  হয় আমারও।

লেখাপড়ায় খারাপ হলেও দুষ্টামি ছিলাম অন্যদের থেকে বেশ এগিয়ে। যদি এ  বিষয়ে পরীক্ষা হতো আমি নিঃসন্দেহে জিপিএ ৫ পেতাম বলতো আমার শিক্ষকরাই। এদিকে দুষ্টামির জন্য প্রতিদিন স্যারের মার যেন ছিল আমার রুটিন।

প্রাইভেট পড়ার সময় সামনের বেঞ্চে বসতো মেয়েরা, আর আমি সহ কয়েক বন্ধু বসতাম তাদের পিছনের বেঞ্চে। সেখানে বসা মানেই লেখাপড়ার বারোটা বাজা। এখানে পড়তে এসে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের আশা পূরণ না হলেও মনেহলো এবার সত্য প্রেমের দেখা পেলাম। পরে গেলাম সামনের বেঞ্চে বসা লিমা নামের এক মেয়ের প্রেমে। ভাবলাম বাঁচবোই কয়দিন একেই তাহলে জীবন সঙ্গী করে নিব। আমার এগুলো ভাবতে ভাবতেই একদিন শুনলাম এক স্যারের হাত ধরে (মেয়েটার সম্পর্কে ভাই) চলে গিয়ে তাকেই জীবন সঙ্গী করে নিয়েছে লিমা। এই মেয়েটাও যখন হলো না তাহলে আর কাউকে আমার জীবন সঙ্গী করা হলো না’ সেই শোক নিয়েই কেটে গেল কলেজ জীবন।

কিছুদিন পরে লেখাপড়া করার জন্য চলে এলাম ঢাকায়। সাথে ছিল এলাকার বন্ধুরাও। এখানে আসার পর বন্ধুরা তখন আমাকে এক অদ্ভুত তত্ত্ব দেওয়া শুরু করল। আমি নাকি সেই প্রাণী, যার সঙ্গে যে কারও প্রেম হলেই তার নাকি বিয়ে হয়ে যায়! প্রেমিকার বিয়ে দিতে আমি নাকি এক্সপার্ট!

বন্ধুদের নিষ্ঠুরতায় আমার মনে তীব্র জেদের সঞ্চার হয়, প্রেম আমাকে করতেই হবে! এবং তারচেয়েও বড় কথা, প্রেমিকাকেই বিয়ে করতে হবে! বন্ধুরা যা বলে তা ভুল প্রমাণ করে ছাড়ব! এই তীব্র জেদের ভেতর এলো ফারহানা। কিন্তু দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে, তার বিয়ে আগে থেকেই ঠিক হয়ে ছিল। শুধু ডেট ফিক্সড হয়নি।

ফারহানা এলো, আমি প্রেমে পড়লাম এবং ফারহানার বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে গেল। ফারহানার সঙ্গে তিন দিনের প্রেম ভেঙে খানখান হয়ে গেল। ভাঙা মন নিয়ে ভাবলাম, বন্ধুরা যা বলে তা-ই বোধ হয় ঠিক! আমি যাকে ভালোবাসি তারই নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে যায়।

মন খারাপের এই কালে এগিয়ে এল আবার বন্ধুরাই। আমার এক বড় ভাইয়ের বোন নাম ‘পরী’। তার বিয়ে হচ্ছে না। দেখতে খারাপ, পড়ালেখায় খারাপ ইত্যাদি কিছুই না। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে পরীর বিয়ে হচ্ছে না। একদিন আমার কয়েক বন্ধু এসে বলল ভাইয়ার ওই বোনটার জন্য তুই-ই যদি কিছু করতে পারিস। কিছু কর প্লিজ বন্ধু…

দ্যাত… ! বিয়ে হচ্ছে না তাই আমি এখানে কী করব?
: তুই যদি পরীকে ভালোবাসিস তাহলে ওর নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে যাবে!
: কী বলিস এই সব? ফালতু বকা বাদ দে, আমি এসবের ভিতর নাই, তাও আবার ভাইয়ার বোন…!
: আমরা জানি তুই পিছিয়ে পরার মতো ছেলেই না, জানি তুই কিছু একটা করতে পারবি, প্লিজ কর না বন্ধু…

কি আর করা, বন্ধুদের এতো আকুতি যেন আমার পুরনো সব কিছুকেই ভুলিয়ে দিল। পরীকে নিয়ে রিকশায় কয়েকদিন ঘুরলাম ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে। এক মাস যেতে না যেতেই ওর ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল। পরীর জন্য সম্বন্ধ এলো। ছেলে বেসরকারি চাকরি করে, ফ্যামিলিও বেশ ভালো। আমি ‘আই লাভ ইউ’ বলার তিন মাসের মাথায় পরীর বিয়ে হয়ে গেল। ফেসবুকে এখনো তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। গত কালকেও কথা হলো পরীর সঙ্গে, সে লিখে পাঠিয়েছে, ‘ভাইয়া, তুমি না থাকলে যে আমার কী হতো!’আমি এখন অনেক ভালো আছি, আমাদের জন্য দোয়া করিয়ো। এসব দেখে আমি বুকে পাথর চাপা দিয়ে একটা স্মাইলি পাঠিয়ে কনভারসেশন শেষ করি!

সর্বোপরি, ভাবছি, আর প্রেম নয়, এবার একেবারে বিয়েই করে ফেলব ……

Facebook
Twitter
WhatsApp