ডরথা পুইন্তিঃ সিরিয়াল কিলিং জগতের এক ডাইনি বুড়ির গল্প

ইসতিয়াক আহমেদ, লাইফস্টাইল কন্ট্রিবিউটার, অনলাইন আপডেট। ডরথা পুইন্তি সিরিয়াল কিলিং এর জগতে একটি কুখ্যাত নাম। তিনি অত্যন্ত ধুরন্ধর এবং মেধাবী খুনী ছিলেন। ১৯২৯ সালের ৯ জানুয়ারী ক্যালিফফোর্নিয়া শহরের রেডল্যান্ডে জন্ম নেয়া এই সিরিয়াল কিলার পরিচিত ছিলেন Death House Landlady নামে। তার ভিক্টিমের সংখ্যা ৯ জন। তিনি সবগুলো খুনই করেন ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ এর মধ্যে।

ডরথা পুইন্তির পুরো নাম ডরথা হেলেন গ্রে। তার মায়ের নাম ছিল ট্রুডি ম্যাই আর বাবার নাম জেমস গ্রে। তার বাবা মা দুজনেই তুলার খামারে কাজ করতেন। ১৯৩৭ সালে পুইন্তির বয়স যখন ৮ বছর তখন তার বাবা মারা যান। এর পরের বছরই তার মাও এক সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন। এর ফলে যতদিন না তার কোন আত্মীয় তাকে নিতে ক্যালিফোর্নিয়া শহরে আসেন, ততদিন তাকে একটি অনাথ আশ্রমে থাকতে হয়। পরবর্তী জীবনে তিনি তার অতীত জীবন নিয়ে প্রচুর মিথ্যা কথা বলতেন। তিনি পরবর্তীতে বলতেন, তার জন্ম হয়েছিল মেক্সিকোতে।

১৯৪৫ সালে তিনি ফ্রেড ম্যাকফাউল নামে এক সৈনিককে বিয়ে করেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ এর মধ্যে তার দুই মেয়ের জন্ম হয়। এদের একজনকে তিনি দত্তক দিয়ে দেন এবং আরেকজনকে তার এক আত্মীয়কে দিয়ে দেন। ১৯৪৮ সালে আরেকবার অন্তঃসত্বা হলেও মিসক্যারেজ হয়। ওইবছরের শেষের দিকে ফ্রেড তাকে ত্যাগ করে অলে যান। পরবর্তীতে এই বিয়ে নিয়েও তিনি মিথ্যা বলতে শুরু করেন। তিনি বলতেন, তার প্রথম স্বামী নাকি হার্ট এটাকে মারা গিয়েছিলেন।

এর কিছুদিন পর চেক জালিয়াতি করার সময় ধরা পড়েন ডরথা। এজন্য ছয় মাস জেল খাটতে হয় তাকে।  জেল থেকে বেরোনোর পর একজন সল্প পরিচিত পুরুষের সাথে সময় কাটানোর ফলে তিনি অন্তঃসত্বা হয়ে পড়েন এবং এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। এই সন্তানটিকেও তিনি দত্তক দিয়ে দেন।

১৯৫২ সালে তিনি এক্সেল জোহানসন নামের এক ব্যাক্তিকে বিয়ে করেন। তাদের প্রায় ১৪ বছরের বৈবাহিক জীবন ছিল। ১৯৬০ সালে একটি অবৈধ পতিতালয় চালানোর অভিযোগে ডরথাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে ৯০ দিনের কারাদন্ড দেয়া হয়। ১৯৬৬ সালে জোহানসনকে তিনি ডিভোর্স দিয়ে রবার্তো পুইন্তি নামে একজনকে তিনি বিয়ে করেন।  রবার্তো ডরথার চেয়ে বয়সে ১৯ বছরের ছোট ছিলেন। দুবছর পর তাদেরও ডিভোর্স হয়ে যায়।

এরপর ডরথা ২১০০ এফ স্ট্রীট, স্যাক্রামেন্টো, ক্যালিফোর্নিয়া ঠিকানায় একটী তিন তলা বাসা ভাড়া নিয়ে একটা বোর্ডিং খোলেন। ১৯৭৬ সালে ডরথা পেদ্রো মন্তালভো নামের এক মাদকাসক্ত লোককে বিয়ে করেন। কয়েকমাস পর তাকেও ডিভোর্স দিয়ে দেন ডরথা। ১৯২১ আলে তিনি তার বোর্ডিংটি সরিয়ে ১৪২৬ এফ স্ট্রীটে নিয়ে আসেন। এখানেই তিনি ৯ জনকে খুন করেন।

তার প্রথম শিকার তারই ৬১ বছর বয়সী বন্ধু এবং ব্যাবসায়িক অংশীদার রুথ মনেরোকে। ওষুধের ওভারডোজের কারণে তার মৃত্যু হয়। ডরথা পুইন্তি তদন্তের সময় পুলিশকে জানান যে, স্বামীর সাথে সম্পর্কের জটিলতার কারণে মানসিক হতাশায় ভুগছিলেন রুথ। একারণে রুথ আত্মহত্যা করেছেন বলে তার ধারণা। পুলিশ ডরথাকে বিশ্বাস করে এটাকে আত্মহত্যা বলে রিপোর্ট দেয়।

১৮ আগস্ট, ১৯৮২, ডরথাকে গ্রেফতার করা হয় অবৈধ মাদক ব্যাবসার কারণে। এবার তার পাচ বছরের জেল হয়। কারাগারে থাকার সময় এভারসন গিলমাউথ নামে এক কয়েদীর সাথে বন্ধুত্ব হয়। এই বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে ঘনিষ্ট হতে থাকে। ডরথার মুক্তির তিন মাস আগে এভারসন মুক্তি পান। ডরথার মুক্তির দিনে এভারসন ১৯৮০ ফোর্ড পিকআপ নিয়ে তাকে নিয়ে যেতে এসেছিলেন কারাগারে। মুক্তির পর তারা দুজনে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। খুব দ্রুতই তারা বিয়ের প্ল্যান করতে থাকেন। তারা একসাথে ব্যাংক একাউন্টও খোলেন।

নভেম্বর ১৯৮৫, ডরথা একজন ইসমাইল ফ্লোরেজ নামের কাঠমিস্ত্রিকে নিয়ে আসেন ৩ ফুট বাই ২ ফুট কাঠের বাক্স বানানোর জন্য। তিনি ইসমাইলকে বলেছিলেন তার কিছু পুরাতন বই এবং জঞ্জাল ফেলার জন্য বাক্স বানাচ্ছেন। বাক্স বানানো শেষ হলে ডরথা ইসমাইলকে ১৯৮০ ফোর্ড পিকআপটি দিয়ে বলেন জঞ্জালভর্তি বাক্সটা নদীতে ফেলে দিয়ে আসতে। ইসমাইলও ডরথাকে বিশ্বাস করে নদীতে ফেলে দিয়ে আসে। এর মাসখানেক পর এক জেলে নদী থেকে বাক্সটা পেয়ে পুলিশে খবর দেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাক্সের লাশের অবস্থা খুবই খারাপ পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। তাই বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তদন্ত ছাড়াই লাশ মাটিচাপা দিয়ে দেয়।তখন লাশের পরিচয় পাওয়া না গেলেও পরবর্তীতে ডরথা পুইন্তি গ্রেফতার হলে তদন্তের সময় জানা যায় লাশটি আসলে ছিল এভারসনের।

ডরথার বোর্ডিং এ থাকা অনেককেই খুন করেন ডরথা। যার কারণ কখনোই খুজে পাওয়া যায়নি।

নভেম্বর ১১, ১৯৮৮ পুলিশ একটি মামলার তদন্ত করতে ডরথার বোর্ডিং এ আসে। সেখানে তদন্তের কাজে মাটি পরীক্ষার দরকার হয়েছিল। পুলিশ মাটি পরীক্ষারসময় আভিষ্কার করে মাটির নিচে সাতটি মৃতদেহ। প্রথমদিকে পুলিশ ডরথাকে সন্দেহ করেনি। কিন্ত একদিন হঠাৎ ডরথা কফি কিনতে বের হয়ে সোজা লস এঞ্জেলসে এক স্বল্প পরিচিত বন্ধুর সাথে পালিয়ে যান। যাই হোক টিভি রিপোর্ট দেখে বন্ধুটি ডরথাকে চিনতে পারলে পুলিশে খবর দেন। পরবর্তীতে পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে। তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে ৯ জনকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। বিচারে তিন জনকে হত্যার অভিযোগ সরাসরি প্রমাণিত হয় এবং তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। ২০০১ সালের ২৭ মার্চ কারাগারেই মারা যান এই কুখ্যাত মহিলা সিরিয়াল কিলার।

Facebook
Twitter
WhatsApp