‘ক্রাশ আপ্পি’

বেশ অনেক বছর আগের কথা। আমি আর এক সহকর্মী কোন একটি জরুরী কাজে শেরাটন হয়ে কোথাও যাচ্ছি। পাকিস্তান ক্রিকেট টীম ঢাকায় এসেছে খেলতে। তাদের ক’জনার সাথে ঘটনাক্রমে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলো। দেখা গেলো পাকিস্থান ক্রিকেট টীম আসলে ‘অত্যন্ত বন্ধুবৎসল’। আমাদের দিকে তাদের কয়েকজন বেশ উৎসাহ মাখানো হাসি নিয়ে হাত নাড়ছে।

বাহি্যক ভাবে সুদর্শন তরুণ সেলিব্রিটিদের দেখে সব তরুণীরই হয়তো হৃদয় দোলায়িত হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে নারীবাদীর হৃদয় বোধহয় কিছু ভিন্ন ধাতুতে গড়া হয়ে থাকে। বলাবাহুল্য পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের এই ‘অত্যন্ত বন্ধুবৎসল’ আচরণে আমার রাগে পিত্তি জ্বলে গেলো। ‘বাঙ্গালী মেয়েদের কি মনে করে এরা?’ এই কথা ভাবতে ভাবতে মুখ ঘুরিয়ে চলে আসবো – এমন সময় শুনি পাশ থেকে অত্যন্ত বিচিত্র একটি গোঁ গোঁ ধরণের শব্দ। উৎস সন্ধান করে দেখলাম আমার সহকর্মী তরুণীটি। আনন্দের আতিশয্যে সে মূর্ছিত প্রায়। কোন রকমে বললো ‘নওরীন- পাকিস্তানী প্লেয়াররা-হা- হা- হাত নাড়ছে আমাদের দিকে!!!’

বিস্মিত আমি কোনও রকমে সহকর্মীটিকে ধরে নিয়ে অফিসে ফিরেছিলাম সেদিন। একটু পরে ধাতস্থ হয়ে দেখি যাকে পাচ্ছে তাকেই ধরে ধরে এই অসামান্য (!) কাহিনী বয়ান করে চলেছে সে। ব্ৃদ্ধ এক জেলা জজ কাজ করতেন আমাদের সাথে। শুনে তিনি ভেতরের লাইব্রেরীতে চলে গেলেন, তারপর একটা মোটাসোটা বই এনে ধপ্ করে রাখলেন সহকর্মীর সামনে। তাকিয়ে দেখি মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের অষ্টম খন্ড। ১৯৭১ এ বর্বর পাকবাহিনীর হাতে নারী নির্যাতনের মর্মস্পর্শী বয়ান রয়েছে সেখানে। জজ চাচা বললেন “এই বইটা পুরাটা পড়বা, তারপর আবার শুনবো তোমার মুখে পাকিস্তানী প্লেয়ারদের রূপের বর্ণনা”। সহকর্মী নির্বাক। বইটা সে পড়েছিলো। এরপর প্রায় তিন দিন আমাদের সাথে রাগ করে কথা বলেনি সে। কিন্তু তার মুখে আর কোনদিন পাকিস্তানী ক্রিকেট টীমের গুণগান শুনিনি।

গুলশানের জঙ্গী হামলার পর জঙ্গী তরুণদের চেহারা দেখে ‘ক্রাশ খাওয়া’ কিছু তরুণীর আচরণ নিয়ে বিস্মিত হতে দেখেছি অনেককে। আমি কিন্তু অবাক হইনি মোটেও। যে নারী বিদ্বেষী সমাজ আর ধর্মীয় রীতিনীতি নারীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ধর্ষণ করে প্রতিদিন – সেই সমাজে ধর্ষকামী, মর্ষকামী নারী তৈরী হবে এতে আর আশ্চর্যের কি আছে?

তারিশীর শরীরে নাকি ৩০-৪০ টি শুধু কোপানোর দাগ ছিলো। জানা গেলো ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ইতালীয় মা’টিকে কোপানো হয়েছে শুধু শরীরে নয়, পেটেও! অনাগত শিশুটির জন্য প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলো মা- কাজ হয়নি। কেউ কি বলবেন মায়ের জঠরে ঘুমিয়ে থাকা একটি শিশুর ধর্ম কি? আরও জানা গেলো নারীদের শরীরগুলোই নাকি কোপানো হয়েছে, খোঁচানো হয়েছে সবচেয়ে বেশী সময় নিয়ে, তারিয়ে তারিয়ে, আনন্দ নিয়ে। এই পৈশাচিকতায় দেশী এবং বিদেশী নারীদের মধ্যে বাছ বিচার করেনি পশুরা; বাদ দেয়নি ইসরাত বা অবিন্তাকেও। আবারও অাশ্চর্য হলেন কি? কেনো? ইসলামী মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ নারীদের ভয় পায় সবচেয়ে বেশী- ঘৃণাও করে একারণেই। এ সত্যটি আমি যেমন জানি তেমনি জানেন আপনারা সকলেই।

কি ‘কিউট’ এই জঙ্গী পশুগুলো তাইনা? কি ‘কিউট’ করেইনা তারা কোন এক মায়ের শরীর কোপায় – একবার, দুইবার, তিনবার, তিরিশবার! আর কিছু ইতর, নারী-নাম-সর্বশ্ব চলন্ত মাংসপিন্ডের দল সেই পশুগুলোর চেহারা দেখে ক্রাশ খায়!!!

এই ‘ক্রাশ আপ্পি’দের শরীরে কোন একদিন হয়তো বেড়ে উঠবে কোন একটি হতভাগ্য মানবশিশু! ভাবা যায়?

নওরীন তামান্নার ফেসবুক থেকে

Facebook
Twitter
WhatsApp